বাংলাদেশ ক্রিকেটের রূপকথা!

মুহাম্মদ ফয়সাল আরফিন শান্ত

 



সাল ১৯৯৭, এপ্রিলের ১৩ তারিখ, বসন্তের শেষ দিনের ছটা। হঠাৎ করেই সেদিন বাংলাদেশের আকাশে খুশির ঘনঘটা। ক্যালেন্ডারে থাকুক বসন্ত তবুও সেদিন বর্ষা! আনন্দের বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করলো প্রতিটা বাংলাদেশীর মনে নতুন এক চর্চা। কারণ!? আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ তার নাম খোদাই করে বসিয়েছে! আকরাম খানের হাতে উচিয়ে তোলা ওই ট্রফি যেন মোনালিসা চিত্র হয়ে হাসছে! সেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পরে আরো একবার টিএসসি থেকে ছাত্ররা ১০ অনুপাত ৬ মাপের পতাকা নিয়ে মিছিল বের করেছে। শহরগুলোর রাস্তা থেকে শাখা রাস্তা, সেই রাস্তার গলি থেকে উপ গলি কোথায় যেন সূঁচ ফেলার স্থান নেই! শুরু হয়েছে অতি-আশ্চর্যজনক এক রঙিন উৎসবের খেই। কৃষকের ক্ষেতের আইলে ভাসা রেডিওর ধারাভাষ্যে সেদিন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশে, আহা! কত আনন্দ উড়েছে ক্রিকেটের আকাশে-বাতাসে!


বিংশ শতাব্দির শেষ বিশ্বকাপ! বাংলাদেশ ক্রিকেটের বয়স সবে অল্প ক'বছর, মাত্র হাঁটা শিখেছে দলটা। এমন সময়-ই ইংলিশ মূলকে গিয়ে পড়লো সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানের মুখে, কি হবে সে ম্যাচের ফলটা!? 'Morning Shows The Day' এই কথা যেন ধ্রুব সত্য। তা না হলে দুই ডাব্লিউর সুইং, শোয়েবের গতি সাথে সাকলাইন, আফ্রিদির স্পিন ভেলকিতেও প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলা একটা দল ২২৩ রানও তুলতে পারে!? সেই ম্যাচে ৬২ রানের হার ক্রিকেট বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটনের একটি হয়ে পাকিস্তানকে এখনো কুঁড়ে-কুঁড়ে মারে! বাংলাদেশ বিশ্বকে সেবার আভাস দিয়ে দেয়, লাল-সবুজের পতাকাকে যেন কেউ না করে হেয়।


একবিংশ শতাব্দিতে দুই হাজার সাল এলো! বাংলাদেশ দশম দল হিসেবে সাদা পোষাকের টেস্ট স্ট্যাটাস পেলো। এর পরের গল্পে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। ২০০৩'র আপসেটের বিশ্বকাপে সাদা-মাটা খেলে টূর্ণামেন্ট হোঁচট খায় বাংলাদেশ। ছোট হলেও তাঁরা হোঁচট খেয়ে মাথা নত করে বসে থাকেনি। লোহা আগুনে পুড়ে-পুড়েই কঠিন ইস্পাত হয়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ নামক ইস্পাত তৈরীর সে আগুনের নাম অস্ট্রেলিয়া! পুঁচকে আশরাফুল অজিদের গায়ে যেন পানি ঢেলে দিয়েছে। কার্ডিফে ক্যাঙ্গারুরা হারের তিক্ততা পেয়েছে। কে করতে পারে আমাদের জয় ভিন্ন!? আশরাফুল-ই এঁকেছিলেন আমাদের জয়ের পদ চিহ্ন। তখনকার সবচেয়ে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী জিম্বাবুয়ের সাথে- সে বছরই [২০০৫ সালে ] বাংলাদেশ পেলো সাদা পোষাকের ইতিহাসের প্রথম জয় সাগরিকার মাঠে!


২০০৭ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ, অপরূপ সৌন্দর্যের দ্বীপপুঞ্জের দেশে। বাংলাদেশ গেলো তরুন তুর্কিদের নিয়ে টাইগারের বেশে। মাঞ্জারুল ইসলাম রানাকে হারিয়েছে ক'দিন আগে! বাংলাদেশকে জিততেই হবে যখন ভারতকে পেয়েছে ভাগে। জহির খানকে ডাউন দ্যা উইকেটে এসে ছক্কা হাঁকিয়ে শুরু করেছেন ১৭ বছর বয়সী তামিম সাথে মুশফিক-সাকিবের হাফ-সেঞ্চুরির কীর্তি। মাশরাফি ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়ে গড়েছিলেন সেই ম্যাচের ভিত্তি। সুপার এইটে গায়নার প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে আবারো আশরাফুলের মহাকাব্যিক সেই ৮৭ রানের পথে, প্রমান করলেন বিশালাকার দেহ লাগে না তারকা থেকে মহাতারকা হতে। আফ্রিকার এই দেশের বিপক্ষে - বাংলার বাঘেরা যেন আরো তীব্র, হিংস্র হয়ে জয় লিখলো নিজেদের গৌরবের বক্ষে!


এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ গেলো যতো, ১১ বিশ্বকাপের হোস্ট বাংলাদেশ (ভারত, লংকার সাথে) পেলো প্রথমবারের মতো। এই খবরে বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশে উৎসব, যেন জোয়ান-বৃদ্ধরা ফিরে পেয়েছে তাদের নিজ- নিজ শৈশব। প্রতিপক্ষ শিকার হবে এই আশা, কারণ এটা টাইগারদের ডেরা! যেখানে এসে এক হয়েছে রথী-মহারথীদের মেলা। সেখানেই ক্রিকেট বিধাতা বাংলাদেশের সাথে করলো হেলা! ঘরের মাঠের বিশ্বকাপ যেন বাংলাদেশের বাঘের ছিয়াত্তরের মন্বন্তর! অসহায়, দুর্বল, মাথা নোয়ানো ছিঁড় ধরা এক অন্তর। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে মাত্র ৫৮ রানে লুটিয়ে পড়া আত্মসমর্পণ। আর সাউথ আফ্রিকার কাছে মাত্র ৭৮ রান তুলতেই সব উইকেট বিসর্জন ! সে বিশ্বকাপ বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক বিভীষিকাময় দুঃসহ স্মৃতি। বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীরা কখনো গাইতে চাইবে না সেই দুঃখের গীতি। 


২০১২ এশিয়া কাপে ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানের হার, এদেশের মানুষের কাছে পৃথিবীর ওজনের চেয়ে বেশি কষ্টের ভার! মাশরাফি, সাকিব, মুশফিকের গাল ভেজা সেই ক্রন্দন, বাড়িয়ে দিয়েছে ১৬ কোটি মানুষের হৃদস্পন্দন। লক্ষ্য থেকে ২ রান অল্প, আমৃত্য বেদনাদায়ক এক গল্প!


খেলোয়াড়দের চোখে জল, ১২'র এশিয়া কাপ ফাইনাল ট্রফিতে নাম দেখে বাংলাদেশর কর্তন! পরিশ্রমই সৌভাগ্যের ফল, দেখো ১৫'তে তাঁদের কত রাজকীয় প্রত্যাবর্তন। সাত-সাতটা অপারেশন করা মাশরাফির হাঁটুর দাগ, যেন সবুজের মাঝে লাল রঙে আঁকা মানচিত্রের দাগ। শরীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেলেন, যেন নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় নিজেকেই নিজে বললেনঃ

'আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!' 


সেই বিশ্বকাপে নিজেকে তিঁনি আবিষ্কার করলেন হিসেবে দলের অধিনায়ক অংশ। তারপরে... অস্ট্রেলিয়ার বুকে থেকে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল্লাহ্ রিয়াদ যে চুমু আঁকে, তেমন চুমু পাওয়া যায় না গভীর ভালোবাসারও বাঁকে। রুবেলের ফুল এন্ড স্ট্রেইট ইয়োর্কার মাপ, ইংলিশরা হলো আউট অব দ্যা ওয়ার্ল্ড কাপ! ইংলিশ বধের সেই সাফল্যের গল্প বাঁধা, বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে গাথা। 


মাঝখানে ইংলিশ লায়ন্স আর অজিদের মুখ থুবড়ে ফেলার কারিগর, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রেরণার নতুন এক বাতিঘর। টি- টুয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের কাছে ১ রানের হার, আর নিদাহাস ট্রফির শেষ বলের ছক্কার ভারে হারের সেই শূণ্যতা, বাংলাদেশ ক্রিকেটকে দিয়েছে আরো পূর্ণতা! ওয়ানডে রেংকিং-এ বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানের সুবাদে, ১৭'র চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জায়গা পেলো অবাধে। ব্ল্যাকক্যাপসদের বিপক্ষে সাকিব-রিয়াদের গড়া মহাকাব্যিক আখ্যান, মাপা যাবে না দেখে সেই ম্যাচের পরিসংখ্যান। মূলতান টেস্ট থেকে শুরু করে ভাগ্য আমাদের বারবারই করেছে হতাশ! সেই ভাগ্যই হয়তো দিয়ে গেছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি-ফাইনালের সুবাস। 


১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্ত দল, তবুও প্রত্যাশা অনুযায়ী আনতে পারে নি পরিশ্রমের ফল। এর পিছনে অনেকটাই দায়ী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষের সেই হার আর লংকার ম্যাচে বৃষ্টির জল! সাকিব আল হাসান এক যুগ ধরেই বাংলাদেশের জান, তবুও বিশ্ব যেন মেনে নিতে চায় নি তাঁকে হিসেবে অলনাউন্ডারদের প্রাণ। তাইতো বাংলার নবাব করলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, বিশ্বকাপেই দেখাবেন তাঁর ব্যাট-বলের বিদ্যা! সাকিব আল হাসান ব্রেইন উইথ বিউটি, হাতে মরণাস্ত্র আর উইলো কাঠে ছড়ি ঘুরানো দেখা ক্লিওপেট্টার চোখের চেয়েও আনিন্দ্য সুন্দর! তিঁনি বাংলাদেশের ওয়ান ম্যান আর্মি হয়ে বিশ্বকাপে লিখেছেন যে আখ্যান, ক্রিকেটের ইতিহাস এর আগে কখনো দেখেনি এমন সৌন্দর্যের উপাখ্যান। তার পরেই সাকিব আল হাসানের দীর্ঘ এক বছরের ক্রিকেট নির্বাসনের হিস্ট্রি, যেন হার মানাবে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের লেখা যত আছে জানা-অজানা ট্র্যাজেডি!


ক্রিকেটের বয়স প্রায় দেড়শ হলেও বাংলাদেশ সেখানে মাত্র তরুন, জোয়ান। তবুও, কোনো ধরণের আন্তর্জাতিক শিরোপা পায় নি বলে আক্ষেপ করতে করতে স্বজাতিরা বলিয়ান। ঠিক সে-সময়ে ২০২০ সালে এসে অনুর্ধ ১৯ দলের আকবর আলি নামের এক যুবকের হাতে উঠলো লাল-সবুজদের কাপ্তানির অদৃশ্য আর্মবেল্ট! পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতেতে খুব সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট মাঠেই খেলে, বাংলার যুবারা সেখানে গিয়েই নিজেদের ধরলেন মেলে। বাংলাদেশের বাঘেদের হুংকারে, ভারতকে শিকারে ফেলে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরে লাল-সবুজের প্রতিনিধির অহংকারে! পরের দিন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের 'প্রথম আলো' পত্রিকায় সেই মহাকাব্যের শিরোনাম ছিলো এমনঃ 

          'উনিশের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়!'


ক্রিকেট যদি ভালোবাসা হয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট সে ভালোবাসার হৃদস্পন্দন!ইউনিভার্সের সবচে' সুন্দরী প্রেমিকাও যেখানে মাথা নত করে বলে ক্রিকেট শিল্পীর চিত্রকর্ম, ভদ্রতায় ভেজা রাজকীয় খেলার এক কারুকার্য। শুধু খেলা নয়, খেলার চেয়েও বেশি সুন্দর ক্রিকেটের গৌধূলি বেলা! করোনার মহামারীতে ক্রিকেট নামক প্রেয়সীর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ নেই কোনো মতে।জীবনানন্দের কবিতার মতো যেন পৃথিবীও হাজার বছর ধরে পথ চেয়ে আছে ক্রিকেটের পথে! 


ক্রিকেট-ই ভালোবাসার স্নিগ্ধ, মুগ্ধ, সুন্দরী প্রেয়সীর হাসিমুখ! তাইতো বাংলাদেশীরা শিরোনামহীনের হাসিমুখ গানের লাইনের মতো করেই যেন ক্রিকেটকে বলেঃ 


                      তুমি চেয়ে আছ তাই,

                      আমি পথে হেঁটে যাই

                        হেঁটে, হেঁটে বহুদূর, 

                        বহুদূর যেতে চাই!


বাংলাদেশের একই নদী পদ্মা ভারতে গিয়ে নাম নেয় তার গঙ্গা। বাংলাদেশের ক্রিড়ামোদীরাও ক্রিকেট ভালোবাসে, নাম-দাম শুধু তার আলাদা। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে এসেছে নতুন এক আলপনা, শত দুঃখের মাঝেও বিন্দু মাত্র সুখ এঁকে দিয়েছে তার শৈল্পিক কল্পনা!


এই জগৎ সংসারও আমার কাছে হেলা, যদি আবারো শুরু হয় স্ব-মহিমায় বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা!

বাংলাদেশ ক্রিকেটের রূপকথা! বাংলাদেশ ক্রিকেটের রূপকথা! Reviewed by Catalytic School on September 20, 2020 Rating: 5

No comments:

Search

Powered by Blogger.