ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি প্রস্তুতি পর্ব-০২: প্রশ্নের মানবন্টন ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনা
আমরা গত পর্বে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা সম্পর্কে জেনেছি আজকের পর্বে ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের মানবন্টন ও বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করব। চলো শুরু করা যাক তাহলে,
বুয়েট ভর্তি পরীক্ষা:
বুয়েটে 600 নম্বরের ভর্তি পরীক্ষা হয় এবং সময় দেয়া হয় তিন ঘন্টা। বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় সর্বমোট 60 টি প্রশ্ন আসবে প্রতিটি প্রশ্নের জন্য 10 নম্বর করে মোট 600 নম্বরে ভর্তি পরীক্ষা। ম্যাথ ফিজিক্স কেমিস্ট্রি প্রত্যেকটি থেকে বিশটি করে মোট 60 টি প্রশ্ন থাকবে।
রুয়েট ভর্তি পরীক্ষা:
রুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার ধরন বুয়েট থেকে একটু আলাদা। রুয়েটে মোট 350 নম্বরের পরীক্ষা হয়। এখানে ম্যাথ ফিজিক্স কেমিস্ট্রি এর পাশাপাশি ইংরেজি থেকেও প্রশ্ন করা হয়। রুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় মোট প্রশ্নের সংখ্যা 35 টি এবং প্রত্যেকটির জন্য 10 নম্বর করে দেওয়া হয়। এখানে ম্যাথ ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি থেকে দশটি করে মোট 30 টি প্রশ্ন থাকবে এবং ইংরেজি থেকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে মোট 35 টি প্রশ্ন 2 ঘন্টা সময়ের মধ্যে উত্তর দিতে হবে।
কুয়েট ভর্তি পরীক্ষা:
কুয়েট ভর্তি পরীক্ষার মানবন্টন ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা। কুয়েটে মোট 500 নম্বরের পরীক্ষা হবে এবং সময় দেওয়া হবে তিন ঘন্টা। কুয়েটে মোট 55 টি প্রশ্ন করা হবে যার মোট নম্বর 500। এখানে ম্যাথ ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি এর প্রত্যেকটি থেকে 15 টি করে মোট 45 টি প্রশ্ন থাকবে। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য 10 নম্বর করে দেওয়া হবে অর্থাৎ 45 টি প্রশ্ন এর জন্য 450 নম্বর দেওয়া হবে। এছাড়া ইংরেজি থেকে দশটি প্রশ্ন করা হবে এবং প্রত্যেকটি প্রশ্নের জন্য 5 নম্বর করে মোট 50 নম্বর দেওয়া হবে।
চুয়েট ভর্তি পরীক্ষা:
চুয়েট ভর্তি পরীক্ষার ধরন বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার মতই। এখানে , ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি থেকে ২০টি করে মোট ৬০টি প্রশ্ন থাকবে। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য 10 নম্বর করে মোট 600 নম্বর এর পরীক্ষা হবে এবং 3 ঘন্টা সময় দেওয়া হবে।
এতক্ষণ প্রশ্নের মানবন্টন সম্পর্কে জেনে নিলাম এখন বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
পদার্থবিজ্ঞান:
ফিজিক্স এর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ভর্তি পরীক্ষায় কোনো সংজ্ঞা বা বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন আসেনা যা আসে তা হল ফিজিক্সের ম্যাথ।এজন্য আমি যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিব সেটি হল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশ্ন ব্যাংক থেকে কোশ্চেন সলভ করা। যদি তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাও তবে তোমার অবশ্যই hsc-physics বইয়ের প্রত্যেকটা সূত্র এবং তার প্রতিবেদন সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে কারণ তোমার মাথায় যদি ফিজিক্স এর সূত্রগুলো খুব ভালোভাবে মুখস্ত থাকে তাহলে খুব সহজভাবে তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো সলভ করতে পারবে। ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় যেহেতু প্রশ্নের তুলনায় সময় অনেক কম দেয় সেহেতু আমাকে খুবই দ্রুত সূত্র প্রয়োগ করে গাণিতিক সমস্যা গুলো সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। এডমিশন সৃজনের সময়টাতে বাসায় বসে প্র্যাকটিস করতে হবে কিভাবে কম সময়ে গাণিতিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে হয়। চেষ্টা করবে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে ফিজিক্সের একটি গাণিতিক সমস্যা সমাধান করার। যত বেশি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করবে তত বেশি ফিজিক্সে তুমি দক্ষ হবে এজন্য ফিজিক্স এর গাণিতিক সমস্যার বিভিন্ন গাইড এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ব্যাংক থেকে যত বেশি সম্ভব তত গাণিতিক সমস্যার সমাধান করবে।
গণিত:
ম্যাথের প্রিপারেশন নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার জন্য চেষ্টা করবে কেদার স্যার অথবা অক্ষরপত্র প্রকাশনীর বই এর প্রত্যেকটি ম্যাথ করার। কারণ ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণত ম্যাথ থেকে এই 2 বই এর বাইরে প্রশ্ন করা হয় না। তোমার যদি টার্গেট থাকে ইঞ্জিনিয়ারিং তাহলে কলেজ লাইফের একদম শুরু থেকে অক্ষরপত্র প্রকাশনী এবং এদের স্যারের বইয়ের ম্যাথ গুলো সমাধান করবে এবং এডমিশন সিজনে প্রশ্ন ব্যাংক থেকে যত বেশি সম্ভব তত ম্যাথ করবে।ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় সম্ভবত ম্যাথমেটিক্স এর সবচেয়ে ক্রুশিয়াল পার্ট হচ্ছে ক্যালকুলাস, ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় ক্যালকুলাস থেকেই সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করা হয় অন্যান্য চ্যাপ্টারের তুলনায়।সুতরাং অবশ্যই অবশ্যই তোমাকে ক্যালকুলাসে দক্ষ হতে হবে।।
রসায়ন:
কেমিস্ট্রি থেকে সাধারণত ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় যা প্রশ্ন আসে তার সর্বোচ্চ 40% পার্সেন্ট থাকে গাণিতিক সমস্যার সমাধান এবং বাকি 60% সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণ ভিত্তিক প্রশ্ন। তো তোমাদের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এমন ভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে যাতে তুমি একই সাথে গাণিতিক সমস্যার সমাধানেও দক্ষ এবং মুখস্থ ভিত্তিক প্রশ্ন গুলোতেও দক্ষ। রসায়নের ক্ষেত্রে জৈব যৌগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চ্যাপ্টার। ধরে রাখ কেমিস্ট্রি থেকে যা প্রশ্ন হবে তার ৩০% জৈব যৌগের চ্যাপ্টার থেকে করা হবে। এজন্য জৈব যৌগের চ্যাপ্টার খুব ভালোভাবে আয়ত্তে রাখতে হবে। এছাড়া রসায়নের গাণিতিক সমস্যা গুলোর জন্য অনেক সহায়ক বই পাওয়া যায় এর পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ব্যাংক থেকে যত বেশি সম্ভব গাণিতিক সমস্যা সমাধান করবে।
ইংরেজি:
যদি তুমি ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে থাকো তাহলে ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার জন্য ইংরেজি বিষয়ের জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতি নিতে হবে না। তোমার ইংরেজির বেসিক যদি ভাল হয় তাহলে ওটা দিয়েই ভালো করতে পারবে। ইংরেজিতে সাধারণত transformation of sentence, narration, question answer from passage, right forms of verb, translation, synonym antonym, fill in the blanks etc. এসব থেকেই প্রশ্ন আসে। যদি তোমার ইংরেজিতে বেসিক ভালো থাকে তাহলে তুমি বেসিক দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার ইংরেজি তে খুব ভালোভাবে ব্যাকআপ দিতে পারবে।
আমরা এতক্ষন প্রশ্নের মানবন্টন ও বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করলাম এর পাশাপাশি আমার নিজের ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা তোমাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। অনেককেই দেখা যায় যে এইচএসসি লেভেলের খুবই মেধাবী ও দক্ষ ছাত্র কিন্তু এডমিশন টেস্টে খুব ভালো রেজাল্ট করতে পারে না আবার দেখা যায় এইচএসসি লেভেলের সাধারণ মানের ছাত্র কিন্তু এডমিশন টেস্ট এ অভাবনীয় ফলাফল করে, এরকম ঘটনার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর টি হল তা হল অধ্যবসায়। এইচএসসি পরীক্ষার পরে এডমিশন টেস্ট এর আগে প্রায় তিন মাসের মত সময় পাওয়া যায় এই সময়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় এই সময়কে যারা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবে তারা এডমিশন টেস্টে ভালো রেজাল্ট করবে। আমি এইচএসসি লেভেলের খুব ভাল ছাত্র ছিলাম না সাধারন মানের ছাত্র ছিলাম আমার এইচএসসি রেজাল্ট ছিল 4.92। মানে খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না আর কি, হাহা! কিন্তু আমি আজকে যে স্থানে এসেছি তা হল আমার তিন মাসের পরিশ্রম। এই তিনমাস আমি দৈনিক প্রায় 14 থেকে 16 ঘন্টা পড়ার টেবিলের সময় দিয়েছি। এই তিন মাসে আমি অক্ষরপত্র প্রকাশনীর বইয়ের প্রত্যেকটা ম্যাথ করেছি, ফিজিক্সের প্রতিটা চ্যাপ্টার থেকে 100-150 টা ম্যাথ সলভ করেছি। যারা আমার মতো এভারেজ লেভেলের স্টুডেন্ট তোমরা চেষ্টা করবে ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এই তিনটি থেকে যেকোনো দুটিতে দক্ষ হওয়ার। এমনভাবে দক্ষ হতে হবে যাতে এ দুটি সাবজেক্ট থেকে যে রকমই প্রশ্ন আসুক যত কঠিনই হোক না তুমি যাতে উত্তর দিতে পারো। সবসময় নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখবা, নিজের সামর্থ্য কে বারবার চ্যালেঞ্জ জানাবা। সবসময় মনে রাখবা “ When the going gets tough, the tough gets going.”
এখন ফিরে আসা যাক ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গে,তোমাদের অনেকেরই প্রশ্ন থাকতে পারে কত মার্কসের অ্যানসার করলে চান্স নিশ্চিত, মেরিট লিস্ট এ কতর ভিতরে থাকলে নিশ্চিত চান্স। এ ব্যাপারে আসলে কেউই নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবেনা কত মার্কস এর অ্যানসার করলে নিশ্চিত চান্স পাওয়া যায়। তবে তুমি যদি 50 পার্সেন্ট প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারো তাহলে ধরে রাখতে পারো তোমার চান্স নিশ্চিত।আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় পার্শিয়াল মারকিং দেওয়া হয় । তুমি যদি কোন প্রশ্ন সম্পূর্ণভাবে সমাধান করতে না পারো তাহলে তোমার উত্তরের ভিত্তিতে পার্শিয়াল মার্ক দেওয়া হবে এইজন্য চেষ্টা করবে যাতে খাতা খালি রেখে না আসো। বুয়েটে মেরিট লিস্ট এ ১২০০ এর ভিতর এবং বাকি ৩টা তে যদি ৩০০০এর ভিতর থাকো তাহলে তোমার সিট কনফার্ম।
আরেকটা খুবই কমন প্রশ্ন শোনা যায় যে “বুয়েট তো বেস্ট কিন্তু বুয়েটের পরে সেকেন্ড বেস্ট কোনটি?” এই প্রশ্নটি আসলে সঠিক কোন উত্তর নেই তুমি যেখানে ভর্তি হবে ওটাই তোমার জন্য বেস্ট। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্বকীয়তা আছে নিজস্ব ইউনিক কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেমন ধরো স্ট্রাকচারাল বিউটির কথা বললে কুয়েট ক্যাম্পাস এগিয়ে থাকবে আবার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা বললে চুয়েট ক্যাম্পাস এগিয়ে থাকবে আবার শহরের ভিতরে ক্যাম্পাস হওয়ায় শহুরে সব সুবিধা রুয়েটে পড়লে অন্যান্য গুলো থেকে বেশি পাওয়া যাবে।
আমি যেহেতু নিজের রুয়েটে পড়ি সেহেতু রুয়েটে সুনাম না করাটা পাপ হবে,হাহা! ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার একটা পরিসংখ্যান বলি, বুয়েটে ১০৬৫ সিটের বিপরীতে মেরিট লিস্ট এ ১৪০০ পর্যন্ত ভর্তি হওয়ার জন্য কল করা হয়েছে, চুয়েটে ৮৯০ সিটের বিপরীতে মেরিট লিস্ট থেকে প্রায় ৩৭০০ পর্যন্ত কল করা হয়, কুয়েটে ১০৩৫ সিটের বিপরীতে মেরিট লিস্ট এ প্রায় ৪২০০ পর্যন্ত কল করা হয়েছে এবং রুয়েটে ১২৩০ সিটের বিপরীতে কল করা হয়েছে মেরিট লিস্ট থেকে ৩৬৭০ পর্যন্ত।
আশা রাখি তোমাদের সাথে খুব শীঘ্রই দেখা হবে 152 একরের দেবদারু ঘেরা রুয়েট ক্যাম্পাসে। শুভ কামনা সকলের জন্য।
ইঞ্জিনিয়ারিং এডমিশন সম্পর্কিত তোমাদের যে কোন জিজ্ঞাসা থাকলে আমাকে ইমেইল করতে পারো আমার ইমেলের ঠিকানা: mujibuddin@hotmail.com
মুজিব উদ্দিন মেহেদী
তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল(EEE) বিভাগ(২য় বর্ষ)
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)
ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি প্রস্তুতি পর্ব-০২: প্রশ্নের মানবন্টন ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনা
Reviewed by Catalytic School
on
September 05, 2020
Rating:
No comments: