একটি গাছের আত্মকথন

তাসফিকুর রহমান ছিদ্দিক 




নিজের বয়স মনে রাখিনি। জন্ম হওয়া থেকে পৃথিবীর নানা রূপের হিসেব রাখতে রাখতে নিজের বয়সের হিসেব গুলিয়ে ফেলেছি আজ বহুকাল।কতশত গ্রীষ্মে কত শ্রান্ত পথিক কে আশ্রয় দিয়েছি, কত বর্ষায় স্নান করেছি, কত শরৎ এর কাশ আমার চারপাশে মাথা দুলিয়েছে, কত শীত কত বসন্তের বাতাস আমার শরীর ঘিরে বয়ে গেছে, তা সত্যিই মনে রাখতে পারিনি। আজ আমি বয়সের ভারে জীর্ণ। আমার স্মৃতিচারণায় আজ বলে যাব এই দীর্ঘ জীবনের গল্প।


আমার নাম আকাশমণি।আমার যখন জন্ম, চারপাশ তখন ছিল ঘন জঙ্গল। আগেই বলেছি সময়ের জ্ঞান আমার নেই, যা আমি জানি তা হল জন্ম থেকে দেখা চারপাশের পৃথিবীর বদলাতে থাকা রূপ। কালের বিবর্তনে আজ আমার অবস্থান রাজুদের বাডির প্রধান ফটকের পাশে।যেদিন প্রথম ঘুম ভাঙলো আমার, সেদিন বৃষ্টি হচ্ছে মুষলধারে।


খেয়াল করলাম অন্য আরেকটা গাছ আমার মাথার উপর ছাতা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরে জেনেছিলাম ওটা রঙ্গন। ও সেদিন আমায় একটুও ভিজতে দেয়নি। তাই জীবনের স্মৃতিচারণায় আমার প্রথম অর্ঘ্য রঙ্গনের প্রতি। 


আমার থেকে কিছু দূরে ছিল রাজুদের বড় দীঘি। তখন তাতে ফুটত শাপলা আর পদ্ম। দূরের প্রান্তর থেকে স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে আসত; চারপাশ থেকে ভেসে আসত মিষ্টি ফুলের সুগন্ধ, মৌমাছি প্রজাপতি ফড়িং খেলা করে বেড়াতো আমার চারধারে; এমন মনোরম পরিবেশে ধরিত্রীর বুকে নিজের শিরা-উপশিরা বিছিয়ে দিয়ে আমি বড় হতে লাগলাম।


তখন একটু বড় হয়েছি; একদিন দেখলাম আমার থেকে কিছু দূরে, জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করছে একদল মানুষ। সেদিন খানিক ভয় হয়েছিল: কিন্তু আমি রয়ে গেলাম। তারপর প্রায়ই দেখতাম, পরিষ্কার করা ওই রাস্তা দিয়ে সারি বেঁধে যাচ্ছে পালকি, গরুর গাড়ি।এর কিছু দিন পর রাজুর দাদা তাদের বসতির জন্য একটা ঘর বানিয়েছেন আমার পাশে।


এই সময় আমি খানিক শক্ত সমর্থ হয়েছি; তখন আর জোর বাতাসও আমায় টলাতে পারে না। মাথার ওপর দিকে বড় ডাল থেকে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করেছি অল্প অল্প করে, তাতে ছোট ছোট পাতা গজিয়েছে।


আমার পাশের গাছগুলোর মতন, আমার ডালেও রংবেরঙের পাখি এসে ভিড় করতে শুরু করেছে। চারপাশে লোকের আনাগোনা বাড়ছে দিন দিন। যাওয়া-আসার পথে কেউ কেউ মাঝেমধ্যে আমার ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে নিত। ব্যস্ত-সন্ত্রস্ত জীবনে এই ছায়াতে এরা শান্তি খুঁজে পেত। রাজু ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।নিয়মিত বন্ধুদের নিয়ে আমার ডালে বসে গান গায়, আমার হলুদ ফুল গুলো নিয়ে বাতাসে উডায় দেয়।


পাখিরা আমার ডালে বাসা বাধত।পাখিগুলো যখন ডিম দিত, আমি আমার পাতা দিয়ে সযত্নে আগলে রাখতাম সেই ডিম। তারপর সেই ডিম ফুটে যেদিন ছোট্ট ছোট্ট ছানা বের হতো, মনটা আনন্দে ভরে যেত। 


এই যখনকার কথা বলছি, তখন আমার চারপাশ আর আগের মত নেই। রঙ্গন কে কেটে ফেলা হয়েছে আজ বেশ কিছুদিন; চারিদিক জঙ্গল থেকে ধীরে ধীরে একটা ছোট গ্রামের চেহারা নিচ্ছে। 


এরপর বহুকাল যাবৎ নিজের চারপাশকে ধীরে ধীরে আরো ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখেছি। অনতিদূরে দেখেছি ছোট-বড়ো বাড়ি গড়ে উঠতে। আর দেখেছি নতুন নতুন মানুষকে। পালকি আজকাল আর তেমন দেখা যায় না। 

একদিন রাজুর বন্ধুদের নিয়ে ক্রিকেট খেলার সময় বল আমার ডালে আটকা পড়ে। আমাকে অনেক ঝাডানোর পরও বলটি পডল না। রাজু’র দাদা আমার ছোট ডালটা কেটে দিয়েছিল। তখন রাজুর খুব মায়া হচ্ছিল আমার প্রতি। এরপর থেকে সে নিয়মিত আমার গোড়ায় পানি দেয় এবং আগাছা পরিস্কার করে। 


কোন এক গ্রীষ্মকালের বৈশাখ মাসের পড়ন্ত বিকেলের কথা।গুমোট গরম পড়েছিল সেই দিন। সাধারণত বিকেলে আমার চারপাশে অনেক লোকজন বেড়াতে আসে। কিন্তু সেই দিনের পথঘাট ছিল জনমানব শূন্য। সারাদিনের গরমে একটি পাতা নাড়ানোর সামর্থ্যও আর আমার নেই।


এমন সময় হঠাৎ কালো আকাশে মেঘ গর্জন করে এল তুমুল ঝড়। সেই ঝড়ের মধ্যে মাথা তুলে নিজের শিরা-উপশিরা দিয়ে ধরিত্রীর বুক সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে নিজের আব্রু বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এমন সময় দেখতে পেলাম সামনের জাম গাছটা হুড়মুড় করে ওপরে পরলো।


দিঘির ধারে শিমুল গাছটা গোড়া থেকে ভেঙে পরল দীঘির জলে। কোথা থেকে একটা ছাতা ঝড়ের দমকা হাওয়ায় উড়ে এসে আটকে গেল আমার একটা ডালে। সেই দিন শত চেষ্টা করেও আমার শাখা-প্রশাখায় থাকা পাখির বাসার ছোট ছোট ডিমগুলোকে বাঁচাতে পারিনি।


বাঁচাতে পারিনি পাখির ছোট ছোট ছানাগুলোকেও। চোখের সামনে উপড়ে পড়তে দেখেছি নিজের ভাই বন্ধুর শরীরকে। এরই মধ্যে বৃষ্টি নামল মুষলধারায়। যে গাছগুলো ভেঙে পড়েছিল সেইখানকার পাখিগুলো এসে কোনরকমে আশ্রয় নিল আমার কোটরে।


ঝড় যখন থামলো, তখন দেখলাম চারিদিকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে আছে উপড়ে পড়া গাছ, রংবেরঙের নাম-না-জানা পাখির মৃতদেহ, আর আমার একটা শাখা থেকে ঝুলে রয়েছে দাবিদারহীন কালো রঙের একটা ছাতা।

একদিন রাজুর বাবা আমাকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।রাজু তো ভীষণ রেগে গেল।শেষমেষ রাজুর দাদার কথায় সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম।


আজকাল তুলনামূলকভাবে গরম পড়ে বড় বেশি। আমার চারপাশের বন্ধুবান্ধব আগের তুলনায় আরো কমে এসেছে। কিন্তু আমি দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছি।


বিভিন্ন কান্ড থেকে নেমেছে বড় বড় ঝুড়ি। বিকেলবেলা বেড়াতে আসা শিশুদের দল আমায় ঘিরে লুকোচুরি খেলে, মিতু আমার গায়ে রশি ঝুলিয়ে দোলনা বেধে হাওয়া খায়, দুপুরে শ্রান্ত ক্লান্ত পথিক আজও আমার ছায়ায় দু’দণ্ড বিশ্রাম নিয়ে যায়।


মোটামুটি এই হল আমার দীর্ঘ জীবনের সংক্ষিপ্তসার। অনেকের হয়তো এই জীবনকে একঘেয়ে মনে হতে পারে। আমার নিজের কখনো তা হয় না। জন্ম থেকে এই একই জায়গায় একাকী স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে, আমি সময়ের ওঠাপড়া দেখেছি আমার চারপাশের সবার থেকে বেশি।


যে মানুষ তার জীবনের চাহিদা অর্জনে প্রতিনিয়ত দৌড়ায়, আমি তাকে রোজ ছায়া দিয়েছি, নিরীহ পাখিকুলকে দিয়েছি খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়। এভাবেই চারপাশের পৃথিবীটুকুকে আমি আমার জীবন দিয়ে রক্ষা করে যেতে চাই সবসময়। এতেই আমার জীবনের সার্থকতা।


Design: Mossarof Hossain Anna

একটি গাছের আত্মকথন একটি গাছের আত্মকথন Reviewed by Catalytic School on September 17, 2020 Rating: 5

No comments:

Search

Powered by Blogger.